rss

শুক্রবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০০৮

বেগমগঞ্জ কালো পুলের বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৩১ তম বার্ষিকী পালিত হয়ে গেল গত ১৬ ডিসেম্বর ২০০২। তারই প্রাক্কালে নোয়াখালী’র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার একটি অকথিত কাহিনী নিয়ে তথ্য অনুসন্ধানের জন্য ছুটলাম নোয়াখালী জেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায়। সেখানে কালের স্বাক্ষী চৌরাস্তা “কালো পুল” যা বর্তমানে পাকা ব্রিজ। তারই দক্ষিণে তথা চৌরাস্তা সংলগ্ন বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাই স্কুল। এই উভয় স্থানই ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনীর মানবতা বিরোধী জঘন্য হত্যাযজ্ঞের কেন্দ্র। সেখানে আজও নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতি ফলক। স্বীকৃতি পায়নি বধ্যভূমির। এই স্থানের মাটির গভীরে আজও আছে অসংখ্য নারী পুরুষের গণ কবর। সেই গণকবরে গুমরে কাঁদে শহীদের আত্মা। আমরা কেউ কখনও তার খবর রাখিনি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে নিরপরাধ মানুষকে হত্যার রোমহর্ষক বিবরণী তথা হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আনার চেষ্টা থেকে এ তথ্যানুসন্ধান।

একাত্তরের ২৬ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করার পর ২২ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত নোয়াখালী জেলা ছিলো হানাদার মুক্ত। ২২ এপ্রিল বিকেল ৫টায় ৬০-৭০ টি যান্ত্রিক বহর নিয়ে পাকিন্তানী সামরিক কনভয় কুমিল্লা-লাকসাম-সোনাইমুড়ি হয়ে বেগমগঞ্জের মীরওয়ারিশপুর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে চৌরাস্তা অভিমুখে রওয়ানা হয়।ঐ দিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সে সময়ের মিরওয়ারিশপুর গ্রামের তরুণ যুবক বর্তমানে আইনজীবী এবিএম ফারুক (৫০) বলেন, "ঐ দিন পাকবাহিনী বেচার দোকান সংলগ্ন আমাদের পৈত্রিক বাড়িতে অবস্থানরত আমার বাবা জনাব ফরিদ মিয়া (টিটি) এবং আমার ভাই মোঃ ফয়েজকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। আমি তখন বাড়ির অদূরে লুকিয়ে ঐ হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করি। এর পর পাকবাহিনী কালো পুল অভিমুখে রওয়ানা হয়। পুলের সন্নিকটে এসে পাক সামরিক কনভয় থমকে দাঁড়ায়। পাক সামরিক কনভয় আসার আগেই স্থানীয় জনসাধারণ কালো পুল ধ্বংস করে দেয়। এতে উত্তর দক্ষিণের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাক সামরিক কনভয় চৌরাস্তায় আসার পথে কালো পুলের দক্ষিণ প্রান্তে একটি প্রতিরোধ যুদ্ধের সম্মুখিন হয়। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয় শহীদ সালেহ আহম্মদ, জহিরুল ইসলাম, পিন্টু প্রমুখ। ঐ পাক সামরিক শক্তির নিকট পরাভূত হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ স্তিমিত হলে পাক সামরিক বাহিনী ঝুলন্ত সেতু নির্মান করে সন্ধ্যা নাগাদ কালো পুল অতিক্রম করে বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাই স্কুলে অবস্থান নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে।"

একাত্তর এর ৯ মাসে অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেদিনের মিরওয়ারিশপুর গ্রামের কিশোর সারোয়ার আলম (৪৫) জানান, “বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাই স্কুলের ক্যাম্পে পাকিন্তানী হানাদার বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ছিলো মেজর বোখারী। এই ক্যাম্পটি ছিলো পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নোয়াখালী জেলার মূল ঘাঁটি।“

একাত্তর এর টগবগে যুবক আবদুস সোবাহান বর্তমান বয়স ৬৫ বছর। বাড়ি চৌরাস্তা সংলগ্ন নাজিরপুর গ্রামে। একাত্তরের পুরো নয় মাস আবদুস সোবাহান চৌরাস্তার কালো পুলের পূর্ব পার্শ্বের বেহাল জালে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। তখন কালো পুল, কাঠের পুল ছিলো অনেকটাই ভাঙ্গাচোরা। তার পাশেই নির্মিত হয়েছে বর্তমানের পাকা ব্রিজ। আবদুস সোবাহান বলেন, “পাক সামরিক বাহিনী টেকনিক্যাল হাই স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করার পর পরেই মাইজদী থেকে ৫ জন নিরপরাধ স্বাধীনতাকামী বাঙালীকে ধরে এনে কালো পুলের উপরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। একজন সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যান। এভাবে পাক হানাদার বাহিনী এ অঞ্চলে নিরপরাধ মানুষ হত্যা শুরু করে।মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসে প্রতিদিন কালো পুলে সর্বনিম্ন ৫/৬ জন ও সর্বোচ্চ ১৫/২০ জন করে মানুষ হত্যা করতো পাকিস্তানী সৈন্যরা। নানা নিষ্ঠুর পন্থায় ওরা হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠতো। নোয়াখালী জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নিরপরাধ মানুষগুলোকে ধরে এনে প্রথমে টেকনিক্যাল হাই স্কুল ক্যাম্পে শারীরিক নির্যাতন করা হোত- তারপর প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কালো পুলের উপর দাঁড় করিয়ে বুলেট বেয়নেটে ঝাঁঝরা করা হতো। এভাবেই চলতো স্বাধীনতাকামী নিরপরাধ মানুষদের উপর মানবতাবিরোধী জঘন্য হত্যাযজ্ঞ। বুলেট বেয়নেট এ ঝাঁঝরা হওয়ার পর লাশগুলো ওয়াপদা খালের পানি খুন রাঙা রঙে রাঙিয়ে ভাসতে ভাসতে পশ্চিমে চলে যেতো। এই টেকনিক্যাল হাই স্কুলের ক্যাম্পেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় চৌমুহনী কলেজের প্রাক্তন প্রধান করণিক মিরওয়ারিশপুর গ্রামের গুলজার হোসেনকে।“

মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস এভাবেই হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে অবশেষে ডিসেম্বর ৫-৬ তারিখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে টেকনিক্যাল হাই স্কুলের ক্যাম্প গুটিয়ে লাকসাম হয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে চলে যায়। কিন্তু তারা রেখে যায় সেখানে অনেক নৃশংসতার চিহ্ন। বহু নারীর সম্ভ্রম হারানোর অব্যক্ত কান্না। অসংখ্য মৃত-অর্ধমৃত নর নারীর কঙ্কালসার দেহ।




► লেখক: গোলাম আকবর, সদস্য সচিব, নোয়াখালী মানবাধিকার জোট
► নোয়াখালী জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত স্মারক স্বাধীনতা ২০০৩ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশকালঃ মার্চ ২০০৩।

ফেইসবুকে যোগ করুন