rss

বৃহস্পতিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০০৯

কাতার ভ্রমণ (পর্ব-৫)

সম্মেলনের শেষ দিনে দেখি ভাঙা হাটের মত ব্যাপার স্যাপার। লোকজন এলোমেলো ঘুরছে। অংশগ্রহণকারী সংখ্যায় কিছুটা কম মনে হলো। অনেকেই হয়তো শহর দেখতে বেরিয়েছে! কেউ কেউ হয়তো ফিরেও গেছে অথবা রাতেই ফিরে যাবে! সম্মেলনে নতুন কোন কিছু নেই। হলরুমে বিভিন্ন জনের প্রদর্শিত পেপারেরই উপস্থাপনা হচ্ছে সরাসরি। প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে। হলরুমের বাইরে নাশতার টেবিলে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আলোচনা চলছে।

Qatar Tribune এ সম্মেলন এবং আগের দিনের বিল গেটসের বক্তৃতার খবর হেডলাইন করলো। সেই পেপার কাটিং প্রদর্শিত হচ্ছে।

নাশতার টেবিলে এক হলাম ড. অনন্য রায়হান, আশির আহমেদ, ফাহিম হুসেইন, ফরহাদ ভাই। আশির ভাই তার ওয়ান ভিলেজ ওয়ান পোর্টাল পেপার নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সবাই মিলে আলোচনা হলো দেশে কিভাবে আইসিটি'র উন্নয়নে কাজ করা যায়। সিদ্ধান্ত হলো ড. অনন্য রায়হান উদ্যোগ নিবেন প্রযুক্তিবিদদের এক করে কোন সম্মেলন করা যায় কিনা। তাহলে পরবর্তীতে নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করা যাবে। সম্ভাব্য অর্গানাইজিং কাজগুলো নিয়ে আলোচনা হলো।
[caption id="attachment_52592" align="alignnone" width="300" caption="ফাহিম হুসেইনের প্রদর্শিত পেপার"]ফাহিম হুসেইনের প্রদর্শিত পেপার[/caption]
বিকেলে আসলো Carlos A. Primo Braga, Director, Economic Policy and Debt in the Poverty Reduction and Economic Management Network (PREM) at The World Bank। তার বক্তৃতায় বেশ হিউমার মেশানো ছিলো। কিছুক্ষণ পর পরই তার কথায় হাসির হুল্লোড় উঠতো। ইংরেজী বক্তৃতা অনুসরণ করার ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা। দেখা গেলো কেউ কিছু বলার পর মনে মনে তার অনুবাদ করছি, এর মধ্যেই আরো কয়েকলাইন বলে ফেললো। শেষে সবকিছু মিলিয়ে একটা তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার জোগাড়। মনে রাখাও কঠিন হয়ে দাড়ায়! সরাসরি ইংরেজীতে চিন্তা করার কোন পদ্ধতি থাকলে ভালো হতো!


এর মধ্যে ভাতিজা দেশে ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। এসেছিলো আমার দুদিন আগে। যাবেও আমার দুদিন আগে। যাওয়ার আগে তার কাছে স্থানীয় একটা সীম কার্ডসহ ফোন ছিলো। ১৫ তারিখ কাতার আসার পর আমার পরিচিত গুলজার ভাই তার থাকার ব্যবস্থা করেছিলো তার এক সহকর্মীর বাসায়। সহকর্মীর একটি ফোন তার কাছে ছিলো যোগাযোগের জন্য। যাওয়ার আগে আমার কাছে ফোনটা রেখে গেলো পৌছে দেয়ার জন্য। আমি সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে কলি আপাকে ফোন দিলাম।

কলি আপা হলো অলৌকিক হাসান এবং টুটুল ভাইয়ের বন্ধু। কাতারেই সেটল করেছে। দেশে থাকতেই ফোন নাম্বার সংগ্রহ করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম কলি আপা হয়তো আমাকে চিনবে না। কিন্তু উনি আগেই টুটুলের সাথে ফোন কথা বলেছিলেন। নাম বলতেই বলে উঠলেন, "আপনার তো ১৫ তারিখ আসার কথা। এত দেরিতে ফোন করলেন!"

ফোনে তার জীবনসঙ্গী আরিফ ভাইয়ের সাথেও পরিচয় হলো। দুজনেই দারুণ মানুষ। অল্প কথাতেই আপন করে নেবার অসাধারণ ক্ষমতা! ঠিক হলো আমি হোটেলে ফিরলে তারা আসবেন।

ডিনার শেষে দেখি আমার পরিচিত সবাই আগেই চলে গেছে। সবার ফ্লাইট রাত ১১টায়। তাই আগেই সম্মেলন থেকে বেরিয়ে গেছে। আমার যেহেতু দুদিন পর, তাই ধীরে সুস্থে নির্ধারিত বাসে রাত ৮.৩০টা নাগাদ হোটেলে ফিরে আসলাম। হালকা বিশ্রাম নিয়ে প্রতীক্ষা। দশটার পরে কলি-আরিফ দম্পতি এলেন। এসেই আর পরিচয় পর্বের জন্য সময় নষ্ট করলেন না। গাড়ী নিয়েই শহরের প্রধান প্রধান আকর্ষণীয় জায়গাগুলোতে নিয়ে গেলেন। সেই সাথে অভিজ্ঞ গাইডের মত বিস্তারিত বর্ণনা। আমি তাদের কর্মতৎপরতায় যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। এই দুজনের সাথে দেখা না হলে আমার কাতার ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যেতো।

প্রথমে গেলাম কাতারের অলিম্পিক ভিলেজে। স্টেডিয়ামের পাশে দারুণ একটা মিনার করেছে। তার পাশেই কারফুর নামে একটা বিশাল শপিং মল। শপিং মলটা দেখে মুগ্ধ না হলে উপায় নেই। বিশাল স্পেস নিয়ে একটাই ফ্লোরে অবস্থান। একদিক থেকে হাঁটা শুরু করলে শেষ হতে চায় না। ছাদটা যেন আকাশের মত সাজিয়েছে। চাঁদ উঠছে। মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।
[caption id="attachment_52593" align="alignnone" width="300" caption="চাঁদ উঠেছে কারফুরের আকাশে"]চাঁদ উঠেছে কারফুরের আকাশে[/caption]
মার্কেটের একেক অংশ একেক শহরের মত করে থিমেটিক্যালি সাজানো। ভেনিসের মত করে এক অংশ সাজানো। ভেনিস শহরের মত করেই টাইলস, নকল বাড়ী, লেক ইত্যাদি ইত্যাদি। কাতার গেলে এই মার্কেটে অবশ্যই একবার হলেও যেতে ভুলবেন না কেউ। মুগ্ধ না হওয়ার কোন কারণ নেই। আমরা যখন পৌছালাম তখন অবশ্য ভীড় একেবারেই নেই। বন্ধ হওয়ার সময় হয়েছে। দ্রুত এক চক্কর দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
[caption id="attachment_52594" align="alignnone" width="300" caption="শপিং মল কারফুরের একাংশ"]শপিং মল কারফুরের একাংশ[/caption]
দু:খের কথা হলো, ক্যামেরা না থাকায় ছবি তুলতে পারলাম না। মোবাইলে দুএক্টা তুলেছিলাম। তবে মোবাইলে ছবি তুলে আরাম নেই, কোয়ালিটিও নেই। তাই ছবি তোলা হলো না। তাছাড়া মোবাইলে রাতের বেলা ছবি একেবারেই যাচ্ছেতাই আসে। তাই ছবি তোলার প্রচেষ্টা বাদ দিলাম। কলি আপা দূ:খপ্রকাশ করলেন। আগে জানালে তাদের ক্যামরা নিয়ে আসতে পারতেন।

এরপর গেলাম শহরের ভেতরের পুরোনো শহরে। কাতারের এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লেগেছে। শহরের একেক অংশ একেক রকমভাবে সাজিয়েছে। যেমন একটা অংশে তাদের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যকলার অনুসরণে সাজানো হয়েছে। সবকিছু পুরোনো আমলের মত তৈরি করা। বাড়ী, ঘর, দোকানপাট। ঢুকলেই মনে হবে ১০০ বছর অতীতে ফিরে গেছি।

আরেকটি অংশে সব উঁচু উঁচু দালান। আলোকসজ্জিত আকাশছোঁয়া দালান শুধু শহরের সমুদ্রপাড়ে ঐ অংশেই আছে। এছাড়া দোহার অন্য অংশে দালানগুলো উচু নয়। বিষয়টা চোখের জন্য খুবই স্বস্তিদায়ক মনে হলো আমার।


সমুদ্র পাড়ে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। এই অংশে সমুদ্রের পাড় বাধাই করা। একেবারেই শান্ত সমুদ্র। পারস্য উপসাগরে এত শান্ত এটা আগে ভাবি নাই। দখিণা বাতাসে আমার স্থানীয় নদীতেও এর চেয়ে বড় স্রোত আছড়ে পড়ে! সে যাই হোক, সমুদ্র পাড়ে একটা দালান দৃষ্টি আকর্ষন করলো। কিছুক্ষণ পর পরই রঙ পাল্টাচ্ছিলো। দালানটা ঠিক কিসের এখন মনে পড়ছে না। কলি আপা বলছিলেন, বছরের এই সময়ে আবহাওয়া সাধারণত এত ভালো থাকে না। আমার ভাগ্য ভালো চমতকার একটা সময়ে গিয়েছি। আসলেই তাই। বাতাস একেবারেই ঠান্ডা। মরুভূমির বাতাস যেরকম উত্তপ্ত হওয়ার কথা, তার ধারে কাছেও নাই। একেবারেই ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস। রাতের বেলা সমুদ্র পাড়ে প্রচুর লোক হাটতে আসে। সময় কাটানোর জন্য দারুণ স্থান।

এরপর গেলাম হেরিটেজ পার্কে। সমুদ্র পাড়ের কাছাকাছিই অবস্থান। হেরিটেজ পার্কে দেখলাম শুধু ফ্যামিলি অ্যালাউড। ব্যাচেলররা পার্কের সীমানার বাইরেই থাকে। আমরা সেখানে পৌছালাম রাত সাড়ে বারোটার দিকে। চা খেতে খেতে পার্ক ঘুরে দেখলাম। তখনো দেখি শিশুরা পার্কে খেলছে। তাদের অভিভাবকরা ঘাসের উপরে বসে বসে গল্প করছে। ফ্যামিলি পার্কের ধারণাটা আমার কাছে চমকপ্রদ মনে হলো। আমাদের দেশে তো রাতের বেলা পার্কের যে পরিবেশ, তাতে করে ফ্যামিলি নিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনাই করা যায় না!

কলি-আরিফ দম্পতি আমাকে যখন হোটেলে পৌছে দিলেন তখন রাত প্রায় দেড়টা বাজে। এতরাত পর্যন্ত আমাকে তারা সময় দিয়েছেন যে শুধু মুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই মন তৃপ্ত হচ্ছে না। অবশ্য এখানেই শেষ নয়। পরের দিনও তাদের সহযোগিতা পেয়েছি। তাদের সহযোগিতা না পেলে কেনাকাটাও করা হতো না। সেই গল্প পরের পর্বে। :-)

ফেইসবুকে যোগ করুন