rss

জালছেঁড়া নদী

জালছেঁড়া নদী
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৯। প্রকাশক: ভাষাচিত্র, ৩য় তলা, আজিজ সুপার মার্কেট, ঢাকা।

প্রান্তজন

প্রান্তজন
শহীদুল ইসলাম মুকুল

শুক্রবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০০৮

ধেয়ে আসছে তোমার দিকে


উ হু! এরকম সাপের মত পেঁচিও না;
চুপচাপ দাঁড়াও, ঠিক মৌন সন্যাসীর মত।
তোমার চোখযুগল এখনো তিরতির করে কাঁপছে।
চোখ বন্ধ কর, স্থির হও;
চিবুকটা তুলে ধরো সামান্য।
হু, এবার ঠিক আছে;
লক্ষ্ণী মেয়ের মতো আচরণ!
এভাবেই থেকো আরো কিছুক্ষণ।
জানোই তো, পালাতে পারবেনা,
ঠেকাবার কোন উপায় নেই-
সহস্র চুম্বন ধেয়ে আসছে তোমার দিকে...




নোয়াখালী
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৮

ফেইসবুকে যোগ করুন

বেগমগঞ্জ কালো পুলের বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৩১ তম বার্ষিকী পালিত হয়ে গেল গত ১৬ ডিসেম্বর ২০০২। তারই প্রাক্কালে নোয়াখালী’র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার একটি অকথিত কাহিনী নিয়ে তথ্য অনুসন্ধানের জন্য ছুটলাম নোয়াখালী জেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায়। সেখানে কালের স্বাক্ষী চৌরাস্তা “কালো পুল” যা বর্তমানে পাকা ব্রিজ। তারই দক্ষিণে তথা চৌরাস্তা সংলগ্ন বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাই স্কুল। এই উভয় স্থানই ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনীর মানবতা বিরোধী জঘন্য হত্যাযজ্ঞের কেন্দ্র। সেখানে আজও নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতি ফলক। স্বীকৃতি পায়নি বধ্যভূমির। এই স্থানের মাটির গভীরে আজও আছে অসংখ্য নারী পুরুষের গণ কবর। সেই গণকবরে গুমরে কাঁদে শহীদের আত্মা। আমরা কেউ কখনও তার খবর রাখিনি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে নিরপরাধ মানুষকে হত্যার রোমহর্ষক বিবরণী তথা হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আনার চেষ্টা থেকে এ তথ্যানুসন্ধান।

একাত্তরের ২৬ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করার পর ২২ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত নোয়াখালী জেলা ছিলো হানাদার মুক্ত। ২২ এপ্রিল বিকেল ৫টায় ৬০-৭০ টি যান্ত্রিক বহর নিয়ে পাকিন্তানী সামরিক কনভয় কুমিল্লা-লাকসাম-সোনাইমুড়ি হয়ে বেগমগঞ্জের মীরওয়ারিশপুর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে চৌরাস্তা অভিমুখে রওয়ানা হয়।ঐ দিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সে সময়ের মিরওয়ারিশপুর গ্রামের তরুণ যুবক বর্তমানে আইনজীবী এবিএম ফারুক (৫০) বলেন, "ঐ দিন পাকবাহিনী বেচার দোকান সংলগ্ন আমাদের পৈত্রিক বাড়িতে অবস্থানরত আমার বাবা জনাব ফরিদ মিয়া (টিটি) এবং আমার ভাই মোঃ ফয়েজকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। আমি তখন বাড়ির অদূরে লুকিয়ে ঐ হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করি। এর পর পাকবাহিনী কালো পুল অভিমুখে রওয়ানা হয়। পুলের সন্নিকটে এসে পাক সামরিক কনভয় থমকে দাঁড়ায়। পাক সামরিক কনভয় আসার আগেই স্থানীয় জনসাধারণ কালো পুল ধ্বংস করে দেয়। এতে উত্তর দক্ষিণের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাক সামরিক কনভয় চৌরাস্তায় আসার পথে কালো পুলের দক্ষিণ প্রান্তে একটি প্রতিরোধ যুদ্ধের সম্মুখিন হয়। সেই প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয় শহীদ সালেহ আহম্মদ, জহিরুল ইসলাম, পিন্টু প্রমুখ। ঐ পাক সামরিক শক্তির নিকট পরাভূত হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ স্তিমিত হলে পাক সামরিক বাহিনী ঝুলন্ত সেতু নির্মান করে সন্ধ্যা নাগাদ কালো পুল অতিক্রম করে বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাই স্কুলে অবস্থান নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে।"

একাত্তর এর ৯ মাসে অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেদিনের মিরওয়ারিশপুর গ্রামের কিশোর সারোয়ার আলম (৪৫) জানান, “বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল হাই স্কুলের ক্যাম্পে পাকিন্তানী হানাদার বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ছিলো মেজর বোখারী। এই ক্যাম্পটি ছিলো পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নোয়াখালী জেলার মূল ঘাঁটি।“

একাত্তর এর টগবগে যুবক আবদুস সোবাহান বর্তমান বয়স ৬৫ বছর। বাড়ি চৌরাস্তা সংলগ্ন নাজিরপুর গ্রামে। একাত্তরের পুরো নয় মাস আবদুস সোবাহান চৌরাস্তার কালো পুলের পূর্ব পার্শ্বের বেহাল জালে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। তখন কালো পুল, কাঠের পুল ছিলো অনেকটাই ভাঙ্গাচোরা। তার পাশেই নির্মিত হয়েছে বর্তমানের পাকা ব্রিজ। আবদুস সোবাহান বলেন, “পাক সামরিক বাহিনী টেকনিক্যাল হাই স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করার পর পরেই মাইজদী থেকে ৫ জন নিরপরাধ স্বাধীনতাকামী বাঙালীকে ধরে এনে কালো পুলের উপরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। একজন সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যান। এভাবে পাক হানাদার বাহিনী এ অঞ্চলে নিরপরাধ মানুষ হত্যা শুরু করে।মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসে প্রতিদিন কালো পুলে সর্বনিম্ন ৫/৬ জন ও সর্বোচ্চ ১৫/২০ জন করে মানুষ হত্যা করতো পাকিস্তানী সৈন্যরা। নানা নিষ্ঠুর পন্থায় ওরা হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠতো। নোয়াখালী জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নিরপরাধ মানুষগুলোকে ধরে এনে প্রথমে টেকনিক্যাল হাই স্কুল ক্যাম্পে শারীরিক নির্যাতন করা হোত- তারপর প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কালো পুলের উপর দাঁড় করিয়ে বুলেট বেয়নেটে ঝাঁঝরা করা হতো। এভাবেই চলতো স্বাধীনতাকামী নিরপরাধ মানুষদের উপর মানবতাবিরোধী জঘন্য হত্যাযজ্ঞ। বুলেট বেয়নেট এ ঝাঁঝরা হওয়ার পর লাশগুলো ওয়াপদা খালের পানি খুন রাঙা রঙে রাঙিয়ে ভাসতে ভাসতে পশ্চিমে চলে যেতো। এই টেকনিক্যাল হাই স্কুলের ক্যাম্পেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় চৌমুহনী কলেজের প্রাক্তন প্রধান করণিক মিরওয়ারিশপুর গ্রামের গুলজার হোসেনকে।“

মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস এভাবেই হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে অবশেষে ডিসেম্বর ৫-৬ তারিখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে টেকনিক্যাল হাই স্কুলের ক্যাম্প গুটিয়ে লাকসাম হয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে চলে যায়। কিন্তু তারা রেখে যায় সেখানে অনেক নৃশংসতার চিহ্ন। বহু নারীর সম্ভ্রম হারানোর অব্যক্ত কান্না। অসংখ্য মৃত-অর্ধমৃত নর নারীর কঙ্কালসার দেহ।




► লেখক: গোলাম আকবর, সদস্য সচিব, নোয়াখালী মানবাধিকার জোট
► নোয়াখালী জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত স্মারক স্বাধীনতা ২০০৩ থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশকালঃ মার্চ ২০০৩।

ফেইসবুকে যোগ করুন

যদি বলতে


যদি বলতে আমাকে ঘৃণা কর,
খুব দূঃখ পেলেও
হয়তো চোখের মধ্যে নিস্পৃহ আলো এনে
কাল্পনিক সুখে মুখে হাসি নিয়ে
ফিরতি পথ ধরতাম।

যদি বলতে ভালোবাসি,
তাহলেতো মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!

হায়, কিছুই বললেনা তুমি!

ফেইসবুকে যোগ করুন

আগামী শীতে


আমার সব ব্যাপারেই খুব আলসেমি।
এই যেমন, শীতের দিনে ঠোঁটে ভ্যাসলিন লাগাতেও আলসেমি।
প্রতি শীতে ঠোঁট ফেটে একাকার।

তোমার আবার ভীষণ উল্টো,
কি শীত কি গ্রীষ্ম
দশ মিনিট পর পরই ভ্যাসলিনে ঠোঁট ভেজানো চাই।
তোমার নরম অধর সযত্ন চর্চায়
আরো নরম তুলতুলে হয়ে উঠতো।
আমি চুম্বনের বাহানায় ঠোঁটে ঠোঁট রেখে উষ্ঞতা নিতাম,
উপরি পাওনা আদরের স্মৃতি হয়ে লেগে থাকা ভ্যাসলিনের কিয়দংশ।
তাই গত শীতে অসহ্য শৈত্য প্রবাহের কালেও
ঠোঁট ফাটেনি।

একটি চুম্বনের জন্য অবলিলায়
শত মাইল পাড়ি দিয়েছি গত শীতে;
বিনিময়ে পেয়েছি ঠোঁট ফাটার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি।

এখন তোমার আমার ব্যবধান হাজার আলোকবর্ষ।
তাই এই শীতে আমার আবার ঠোঁট ফেটেছে।

আগামী শীতে পারবো কি তোমাকে ছুঁতে?



নোয়াখালী
১৪.২.২০০৮

ফেইসবুকে যোগ করুন

সবকিছুই বড় বেশি প্রাণহীন


সবকিছু বড় বেশি প্রাণহীন।
ঘুম থেকে জেগে উঠা,
চলাফেরা, ঘুড়ে বেড়ানো এদিক ওদিক,
নাগরিক পুনরাবৃত্তির চক্রে ঘুরপাক।

রাস্তায় বিকট দানব, হাইড্রোলিক শব্দের চাবুক;
এতটুকুও স্বস্তি নেই। হাসি হাসি মুখগুলো ছাড়িয়ে
সারিবদ্ধ মৃত চোখেদের
পাশ কাটিয়ে যাওয়া নিত্যদিন।

ধুলো জমা পুরোনো কবিতার খাতা
যেন প্রাচীন প্যাপিরাসের বুকে লেখা অভিশাপনামা –নিজেই লিখে রাখা নিজস্ব নিয়তি’র নির্দেশনা ।

প্রাণহীন আড্ডায় পুরোনো স্মৃতির জাবরকাটা
বিষাদের অতলান্তে ডুব ডুব খেলা।

দিনের চক্র শেষে ঘরে ফেরা একই কায়দায়,
একই ভঙ্গিতে নিজস্ব কবরের আঁধারে গুটিশুটি মেরে ঘুম – মৃতের মতো;
মৃতের শহরে আলোকিত আঁধারে আবারো জেগে উঠা প্রতিদিন...

সবকিছুই বড় বেশি প্রাণহীন!



নোয়াখালী
৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৮

ফেইসবুকে যোগ করুন

পতিত ভিটায়


মানুষ হলেই অতীত থাকে
গত সময়ের স্মৃতি থাকে
আমার কোন স্মৃতি নেই
অষ্ট প্রহর কষ্টে পোড়ার শোক নেই।

ভালোবাসলেই সুখ থাকে
সুখের অনেক প্রাপ্তি থাকে
আমার কোন সুখ নেই
সুখের পাশে প্রাপ্তির ঘর ফাঁকাই থাকে।

ঘর থাকলেই ছাউনি থাকে
শ্যামল বরণ নারী থাকে
আমার চৌকাঠ ঠুনকো ঘুনে
পতিত ভিটায় নীলচে রঙা শ্যাওলা জমে।

ফেইসবুকে যোগ করুন

চন্দ্রগঞ্জ ও সোনাইমুড়ির মুক্তিযুদ্ধ - সত্যেন সেন


মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের চর এসে সংবাদ দিল, সামরিক ভ্যান বোঝাই একদল পাকিস্তানি সৈন্যরা ফেনী থেকে চন্দ্রগঞ্জের দিকে আসছে। ওদের যখন চন্দ্রগঞ্জের দিকে চোখ পড়েছে, তখন ওরা সেইখানে লুটপাট না করে ছাড়বেনা। খবর পেয়ে লাফিয়ে উঠলেন সুবেদার লুৎফর রহমান। বেঙ্গল রেজিমেন্টের লুৎফর রহমান, যিনি এই অঞ্চলে একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করেছিলেন। সৈন্যদের সংখ্যা পঞ্চাশ-ষাটজনের মত হবে। এদের প্রতিরোধ করতে হোলে দলে কিছুটা ভারী হয়ে নেওয়া দরকার। খোঁজ-খবর করে অল্প সময়ের মধ্যে মাত্র ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে জড় করা গেল।

সাতজন মানুষ, সাতটি রাইফেল-এই সামান্য শক্তি নিয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে যাওয়াটা ঠিক কি? মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন এই প্রশ্নটা তুলেছিলেন। কথাটা মিথ্যা নয়- এটা একটা দূঃসাহসের কাজ হবে। অথচ হাতে সময় নেই। মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন, তার মধ্যে এই লুন্ঠনকারী দস্যুরা এদের কাজ হাসিল করে সরে পড়বে। চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটে যাবে আর তারা বসে বসে তাই দেখবে। না, কিছুতেই না, গর্জে উঠলেন সুবেদার লুৎফর রহমান, যেভাবেই হোক এদের প্রতিরোধ করতেই হবে। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ওরা অক্ষতভাবে হাসতে হাসতে চলে যাবে, এ কিছুতেই হতে পারেনা। ওরা আমাদের রক্ত নিয়েছে, তার বিনিময়ে ওদেরও কিছুটা রক্ত দিতে হবে।

রাস্তার ধারে একটা বড় রকমের ইটের পাঁজা। কে যেন কবে একটা দালান তোলবার জন্য এখানে এই ইটগুলি এনে জড় করে রেখেছিলো, অনেকদিন হয়ে গেল, সেই দালান এখনো গাড়ীগুলিকে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। সুবেদার লুৎফর রহমান আর ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা, সেই ইটের পাঁজার পেছনে পজিশন নিয়ে দাঁড়ালেন। এখান থেকেই তাঁরা সেই হামলাকারী দস্যুদের প্রতিরোধ করবেন, এটা খুবই দূঃসাহসের কাজ তাঁরা জানতেন, তাঁরা তাঁদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চলেছেন। কিন্তু এমন এক একটা সময় আসে যখন জেনে শুনে বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন। অবস্থা বিশেষ বামন হয়েও তাঁদের দানবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। মুক্তিবাহিনীর সুবেদার লুৎফর রহমান বললেন, এখনকার অবস্থা হচ্ছে তেমনি এক অবস্থা। কিন্তু বেশী কথা বলার সময় ছিল না। দূর থেকে অস্ফুট সামরিক ভ্যানের গর্জন শোনা গেলো। ঐ যে, ঐ যে আসছে। ওরা! তাঁরা সাতজন সাতটি রাইফেল নিয়ে তৈরী হয়ে দাঁড়ালেন। সেই অস্ফুট আওয়াজ ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে লাগলো। তারপর একটু বাদেই দেখা গেলো সামরিক ভ্যান পথের ধুলো উড়িয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসছে। উত্তেজিত প্রতীক্ষায় তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি যেন ইস্পাতের মত দৃঢ় আর কঠিন হয়ে এল।

সামরিক ভ্যান দ্রুত আসতে আসতে হঠাৎ থেমে গেলো। না থেমে উপায় ছিল না, কাদের অদৃশ্য হস্তের গুলিতে গাড়ির টায়ারের চাকা ফুটো হয়ে গেছে। একই সঙ্গে কতগুলি রাইফেলের আওয়াজ। বিস্ময়ে, আতঙ্কে সৈন্যরা ঝুপঝাপ করে গাড়ী থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লো। কিন্তু সেই অদৃশ্য হস্তের গুলিবর্ষণের যেন শেষ নেই। সৈন্যদের মধ্যে যারা সামনের দিকে ছিল, তাদের মধ্যে অনেকে হতাহত হয়ে ভূমিশয্যা নিল। একটু বাদেই রাইফেলের আওয়াজ থেমে গিয়ে পল্লী-প্রকৃতির নিস্তবদ্ধতা আর শান্তি ফিরে এল। সৈন্যরা সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তন্ন তন্ন করে চারদিক পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। অদৃশ্য শত্রুরা কি তবে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছে? না, ওদের বিশ্বাস নেই, একটু বাদেই হয়তো ওরা আরেক দিক থেকে আক্রমণ করে বসবে। রাস্তার দু'পাশে অনেক ঝোপঝাড় জঙ্গল। তাদের মাঝখানে ওরা কোথায় আশ্রয় নিয়ে বসে আছে কে জানে। তবে দলে ওরা ভারী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে এমন করে হামলা করতে সাহস পেত না।

চন্দ্রগঞ্জ সমৃদ্ধ অঞ্চল। এখানে এসে অবাধে লুটপাট করা যাবে, এই আশা নিয়ে তারা এখানে এসেছিল। এই অঞ্চলে তাদের একজন দালাল ছিল। তার কাছ থেকে খবর পেয়েই তারা লুটের আশায় এখানে ছুটে এসেছে। তারা শুনেছিলো এখানে তাদের 'বাধা' দেবার কেউ নেই। কিন্তু হঠাৎ করে কে জানে কোথা থেকে এই শয়তানের দল মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কে জানে, হয়তো ওরা ইতিমধ্যে তাদের চারিদিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেছে। প্রতিটি গাছ আর প্রতিটি ঝোপঝাড়ের আড়ালে যে একজন করে শত্রু লুকিয়ে নেই এমন কথাই বা কে বলতে পারে। ওদের রাইফেলগুলি এবার এলোপাথাড়ি ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষণ করে চলল। এইভাবে বহু গুলি অপচয় করার পর তারা থামল।

কিছু সময় নিঃশব্দে কেটে গেলো। সৈন্যরা ভাবছিল, তাদের অদৃশ্য শত্রুরা সম্ভবত পালিয়ে গেছে। এমন প্রবল গুলি বৃষ্টির মধ্যে ওরা কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু তা'হলে যারা হতাহত হয়ে ভুমিশয্যা নিয়েছিলো, ওরা তাদের একজন একজন করে ভ্যানের উপর তুলছিল। ঠিক সে সময়ে আবার কতগুলি রাইফেল এক সঙ্গে গর্জে উঠলো। গুলির পর গুলি আসছে, বিরতি নেই। সৈন্যদের মধ্যে এক অংশ আছে ভ্যানের উপরে, অপর অংশ রাস্তায়। অদৃশ্য হস্তগুলি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এদের লক্ষ্য করে করে গুলি ছুঁড়ছে। একটি গুলিও বৃথা যাচ্ছে না। সৈন্যদের মধ্যে ভীষণ হট্টগোল পড়ে গেল। তারা একটু সামলে নিয়ে আবার প্রবলভাবে গুলি বর্ষণ করে চলল। কিন্তু তাদের সামনে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। এই ভাবে কিছুক্ষণ দু'পক্ষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলল। ইতিমধ্যে সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে। অপর পক্ষে অদৃশ্য প্রতিপক্ষের কি পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তা বোঝার কোন উপায় ছিল না।

অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠল সৈন্যরা। কিন্তু একটু আগে তাদের দালাল সেই লোকটি তাদের সাহায্য করবার জন্য এসে গেছে। সে অত্যন্ত চতুর লোক, চারিদিকে ভাল করে নজর করে সে এই রহস্যটা বুঝতে পারল। দূরবর্তী ইটের পাঁজাটার পেছনে অঙ্গুলী নির্দেশ করে সে বলল, আমার সন্দেহ হয়, ওরা ঐ পাঁজাটির পেছনে দাঁড়িয়ে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক কথাইতো, এই সন্দেহটা সকলের মনেই জাগা উচিৎ ছিলো। কিন্তু এতক্ষণ এই কথাটা ওদের কারও মাথায় আসেনি।

এবার ওদের রাইফেলগুলি একেবারে নিঃশব্দ হয়ে গেল। সৈন্যরা তিনভাগে ভাগ হয়ে অতি সন্তর্পণে তিনদিক দিয়ে এগিয়ে চলল। ইটের স্তুপটাকে ঘেরাও করে ফেলতে হবে। খুব সাবধান, ওদের একটাও যেন সরে পড়তে না পারে।
মুক্তিবাহিনীর জওয়ানরা ইটের পাঁজার আড়াল থেকে সবকিছুই দেখছিল। সৈন্যদের মতলব বুঝতে তাদের বাকী রইলো না।
আর এক মুহূর্ত দেরী করার সময় নেই। এখনই তাদের সরে পড়তে হবে। এই সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে তারা যতটা আশা করেছিল, তারচেয়ে অনেক বেশী কাজ হাসিল করতে পেরেছে। এবার তারা স্বচ্ছন্দে ছুটি নিতে পারে। একজন একজন করে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার কিছুটা বাদে শিকার সন্ধানী সৈন্যরা এসে সাফল্যের সঙ্গে সেই ইটের স্তুপটাকে ঘেরাও করে ফেলল। কিন্তু কি দেখল এসে? দেখল, পাখিগুলি তাদের একদম বোকা বানিয়ে দিয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে চলে গিয়েছে। ইটের পাঁজার পেছনে একই জনপ্রাণী নেই। শুধু মাটির উপরে অনেকগুলি কার্তুজের খোল ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে।

সেদিনকার যুদ্ধে সবসুদ্ধ ২৩ জন সৈন্য হতাহত হয়েছিল। আর মুক্তিবাহিনীর সাতটি জওয়ান সম্পর্ণ অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। যে দেশদ্রোহী দালালটি শত্রুদের সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এসেছিল, এর কয়েকদিন বাদেই মুক্তিযোদ্ধারা তাকে খতম করল।

সেইদিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ঘা খেয়ে পাক সৈন্যদের চূড়ান্তভাবে নাকাল হতে হয়েছিল। চন্দ্রগঞ্জে লুটপাট করা দূরে থাক, হতাহত বন্ধুদের নিয়ে গাড়ী বোঝাই করে ওরা মাথা হেঁট করে ফিরে এসেছিল। কিন্তু এই অপমান আর লাঞ্ছনা ওরা ভুলে যেতে পারেনি। দিন কয়েক বাদে ওরা আবার নতুনভাবে তৈরী হয়ে চলল চন্দ্রগঞ্জের দিকে। তাদের মনের জ্বালাটা এবার ভাল করেই মিটিয়ে নেবে।
পাক-সৈন্যরা আবার হামলা করতে আসছে। এই খবরটা পৌছে গিয়েছিল চন্দ্রগঞ্জে। সুবেদার লুৎফর রহমান এখন সেইখানে নেই, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও কেউ নেই। এবার কে তাদের প্রতিরোধ করবে? ওরা সেদিন আচ্ছামত ঘা খেয়ে ঘরে ফিরে গেছে, এবার ভাল করেই তার প্রতিশোধ তুলবে। চন্দ্রগঞ্জকে এবার ওরা ধ্বংসস্তুপে পরিণত না করে ছাড়বেনা। যাকে পাবে তাকেই মারবে। ওদের হাতে কেউ কি রেহাই পাবে? সারা অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। চন্দ্রগঞ্জের মানুষ ঘর-বাড়ী ছেড়ে পালাতে লাগল। ওরা ওদের যা করবার বিনা বাধায় করে যাবে। কিন্তু চন্দ্রগঞ্জের একটি মানুষ এই কথাটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। মাত্র সেদিন এই চন্দ্রগঞ্জের বুকে ৭ জন মুক্তযোদ্ধা বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ দিয়ে দুর্দ্দান্ত পাক-সৈন্যদের দুর্দশার চূড়ান্ত করে ছেড়ে দিয়েছে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধারা এই অঞ্চলেরই মানুষ, এই মাটিতেই মানুষ হয়ে উঠছে। এখানকার মানুষ, শুধু এখানকার নয়, সারা নোয়াখালী জিলার মানুষ তাদের জন্য গৌরববোধ করে। রাস্তার ধারে সেই ইটের স্তুপটি এখনও সেই যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ রুপে বিরাজ করছে। এর মধ্যে তার কথা কি আমরা ভুলে যেতে পারি? আজ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কেউ এখানে নেই বলে ওরা অবাধে যা খুশি তাই করে চলে যাবে। না, কিছুতেই না, গর্জে উঠলেন তিনি, এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না। আর যদি কেউ না যায়, আমি একাই যাবো, একাই গিয়ে ওদের সঙ্গে লড়াই করবো।

কে এই লোকটি? কি তাঁর নাম? না, তার নাম আমার জানা নেই। কোন খ্যাতনামা লোক নন তিনি। একজন প্রাক্তন সৈনিক। আর দশজন বৃদ্ধের মত তিনিও তাঁর জীবনের শেষদিনগুলি ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করে কাটিয়ে যাচ্ছিলেন। একজন সাধারণ মানুষ। কেউ কোনদিন তাঁর কোন অসাধারণত্বের পরিচয় পাননি। কিন্তু আজ দেশের এক বিশেষ অবস্থায় একটি বিশেষ অনুকূল মুহূর্ত তাঁর ভেতরকার সুপ্ত আগুনকে জাগিয়ে তুলেছে। যেখানে হাজার হাজার মানুষ ভয়ে অস্থির, সেখানে এই একটি মানুষ দৃঢ় নিষ্কম্প কন্ঠে ঘোষণা করলেন, যদি একা যেতে হয়, আমি একাই যাবো, আমি একাই ওদের সঙ্গে লড়াই করব। মরবার আগে এই হিংস্র পশুগুলির মধ্যে একটাকেও যদি মেরে যেতে পারি, তবে আমার জীবন সার্থক হবে।

যারা তার হিতৈষী, তারা তাঁকে নিবৃত্ত করবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। বলেছিল. তুমি একা মানুষ, তার উপর বুড়ো হয়েছ। তুমি কি করে ওদের সঙ্গে লড়াই করবে? কিন্তু কারও কোন বাধা তিনি মানলেন না, দৃঢ়-মুষ্টিতে রাইফেলটা আঁকড়ে ধরে বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। তাঁর এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর তরুণ ছেলে তাঁকে ডেকে বলল, দাঁড়াও আব্বা, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। তোমার মত আমিও ওদের সঙ্গে লড়াই করব। ছেলের কথা শুনে বাপের মুখ আনন্দে উজ্জল হয়ে উঠল। দু’জনের হাতে দুটি রাইফেল, পিতা-পুত্র পাশাপাশি প্রতিরোধ সংগ্রামে যাত্রা করল।
আজও ওরা সেই ইটের পাঁজার পেছনে আশ্রয় নিল। ওরা পিতা-পুত্র পাশাপাশি বসে শত্রুদের আগমনের জন্য অধীর চিত্তে প্রতীক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদের দূর থেকে মোটর ভ্যানের গর্জন শোনা গেল। হ্যাঁ ওরা আসছে। দেখতে দেখতে সৈন্যবাহী গাড়ী একেবারেই কাছে এসে পড়ল। সৈন্যদের মধ্যে অনেকের কাছেই ইটের পাঁজাটি সুপরিচিত। ঐটিকে ভুলে যাওয়া তাদের পক্ষে কোন মতেই সম্ভব নয়, কিন্তু আজও যে কেউ তাদের আক্রমণ করার জন্য এর আড়ালে ওত পেতে বসে থাকতে পারে, এটা তারা ভাবতে পারেনি। ভাবতে না পারা অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু ওরা এই স্তুপটার বরাবর আসতেই পরপর তিনজন সৈন্য গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল। সবাই দেখতে পেল, কে বা কারা তাদের লক্ষ্য করে স্তুপটার আড়াল থেকে গুলিবর্ষণ করে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গেই সৈন্যরা এর পাল্টা জবাব দিল। ইটের পাঁজাটাকে লক্ষ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষণ চলল। এরপর সেই স্তুপের পেছন থেকে আর কোন গুলির শব্দ শোনা গেল না। সৈন্যরা একটু সময় অপেক্ষা করল, তারপর ছুটে গেল স্তুপটার সামনে। উদ্যত রাইফেল বাগিয়ে ধরে যখন তারা পায়ে পায়ে সেই স্তুপটার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন দেখতে পেল, সেইখানে এক বৃদ্ধের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে আছে।
কিন্তু অস্ত্র বলতে কোন কিছু সেখানে নাই, শুধু কয়েকটা কার্তুজের খোল পড়ে আছে।ওরা বুঝল, এই বৃদ্ধের সঙ্গে আরও যারা ছিল তারা অস্ত্রসহ পালিয়ে গিয়েছে। আমি ভাবছি, যেদিন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে, স্বাধীন হবে, সে দিন পবিত্র এই জায়গাটিতে সেই গৌরবময় প্রতিরোধ সংগ্রামের স্মারক হিসাবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ কি গড়ে উঠবে? চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধের পর সুবেদার লুৎফর রহমান নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে শিকারের সন্ধানে ছুটে চলছিলেন। তাঁর এক মুহূর্তও বিশ্রামের অবকাশ নেই। তিনি পাক সৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কে দক্ষ শিকারীর মত তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ফিরছিলেন। মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচরেরা নিত্য নতুন সংবাদ নিয়ে আসছে। আর সেই সূত্র অনুসরণ করে তাদের মুক্তিবাহিনী যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেই শত্রুদের উপর ঘা দিয়ে চলেছে।

আঘাতের পর আঘাত হানো কখনও ডাইনে কখনও বাঁয়ে, কখনও সামনে থেকে, কখনও বা পেছন থেকে। ওদের অস্থির আর পাগল করে তোল। ওদের কোন সময় স্বস্তিতে বা শান্তিতে থাকতে দিও না, ওদের প্রতিটি মুহূর্ত দূরভাবনায় কাটুক। ওরা যেন ঘুমের মধ্যেও দূ‍স্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠে। মুক্তিবাহিনী এই নীতি অনুসরণ করেই কাজ করে চলছিল।ওরা হামলাকারীদের নিশ্চিত মনে বিশ্রাম করতে দেবেনা, নিজেরাও বিশ্রাম নেবেনা।

এপ্রিলের শেষভাগ। খবর এল, একদল সৈন্য কুমিল্লার লাকসাম থেকে ট্রেনে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছুবে। লুতফর রহমান এই খবর পাওয়ার সাথে সাথেই তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। স্থির হোল, ওদের বিনা বাধায় এগোতে দেওয়া হবেনা, সোনাইমুড়ি স্টেশনেই এই হামলাকারীদের উপর হামলা করতে হবে। রেলস্টেশনে চড়াও হয়ে আক্রমণ। হয়তো সেজন্য মুক্তিবাহিনীকে বেশ কিছুটা মূল্য দিতে হবে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি বরণ করে নিতে হবে। তা হোক, এই শিকারকে কিছুতেই ফসকে যেতে দেওয়া চলবে না।

কিন্তু এবার আর চন্দ্রগঞ্জের মত সাতজন মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে চলবেনা। এবার আর আগেকার মত আড়াল থেকে যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ চলবে প্রকাশ্য, মুখোমুখি। ওদের সৈন্য সংখ্যা বড় কম নয়, আক্রমণ করতে হলে বেশ কিছুটা শক্তি সংগ্রহ করে নিতে হবে। সেই অল্প সময়ের মধ্যেই পঞ্চাশজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে সোনাইমুড়িতে এনে জড় করা গেল। অবশ্য যতদূর জানা গিয়েছে সৈন্যদের সংখ্যা এরচেয়েও অনেকটা বেশী, তা হোক, এই শক্তি নিয়েই ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

নির্দিষ্ট সময়ে সৈন্যবাহী ট্রেনটা সোনাইমুড়ি স্টেশনে এসে পৌছল। মুক্তিবাহিনী কাছেই কোন একটা জায়গায় লুকিয়ে ছিল। ট্রেনটা এসে পৌছাবার সাথে সাথেই রাইফেলধারী মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্যূতগতিতে ছুটে এসে ট্রেনটাকে ঘেরাও করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তারা ট্রেনের আরোহীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগল। ওরা গাড়ীর ইঞ্জিনটাকেও লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছিল। ড্রাইভারহীন ট্রেনটা অচল হয়ে গেল।

প্রকাশ্য দিবালোকে এইভাবে আক্রান্ত হতে হবে, পাক সৈন্যরা তা কল্পনাও করতে পারেনি। তারপর ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে, একটু সময় ওরা হতভম্ব আর স্তব্ধ হয়ে রইল। পর মুহূর্তেই তারা তাদের রাইফেল বাগিয়ে ধরে হুড়মুড় করে কামরা থেকে প্লাটফর্মের উপর নেমে পড়তে লাগল। ওদের মধ্যে কয়েকজনকে কামরা থেকে নামবার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ দিতে হল।

এবার দু’পক্ষে শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। এবারকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে রেলস্টেশনের উপর এ ধরনের লড়াই আর কোথাও ঘটেছে বলে শোনা যায়নি। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি রেলস্টেশন এজন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রায় তিনঘন্টা ধরে এ লড়াই চলল। এই যুদ্ধে পঁয়ত্রিশজনের মত পাক সৈন্য নিহত হয়েছিল।মুক্তিযোদ্ধাদের ছয়জন শহীদ হলেন। ইতিমধ্যে খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। খবর পেয়ে ঘন্টাতিনেক বাদে আক্রান্ত পাক-সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য চৌমুহনী থেকে সামরিক ভ্যানে করে একদল সৈন্য ঘটনাস্থলে এসে পৌছল। এবার পাক সৈন্যদের মোট সংখ্যা দাঁড়াল আড়াইশতের উপরে। হতাহতের বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা তখন আনুমানিক চল্লিশ এ এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতার নামান্তর মাত্র। মুক্তিযোদ্ধারা এমন ভুল কখনও করেনা। তারা যেমন বিদ্যূৎগতিতে এসে আক্রমণ করেছিল, তেমনিভাবেই ঘটনাস্থল থেকেই অদৃশ্য হয়ে গেল। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের পেছন পেছন ধাওয়া করে আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হল।

।।শেষ।।



রবিউল হোসেন কচি সম্পাদিত নোয়াখালী পৌরসভা কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক স্মারকগ্রন্থ “নোয়াখালী” থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশকালঃ ২ জুলাই ১৯৯৮

ফেইসবুকে যোগ করুন